আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রতিদিনই আমাদের কোনো কিছুকে টানতে হয়, ঠেলতে হয় কিংবা ধাক্কা দিতে হয়। কোনো বস্তুর গতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চাইলেই আমরা সেটাকে টানি, ঠেলি বা ধাক্কা দিই অর্থাৎ বল প্রয়োগ করি। বল প্রয়োগ করে স্থির কর্তৃকে গতিশীল করা যায়, আবার গতিশীল কস্তুর গতি পরিবর্তন করা যায়, এমনকি গতি থামিয়েও দেওয়া যায়। এ অধ্যারে আমরা জড়তা, বল, স্থিতি এবং গতি আলোচনা করব। পতির উপর বলের প্রভাব বোঝার জন্য আমরা নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে বলের প্রকৃতি জানব। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে বলের পরিমাপ করব এবং নিউটনের তৃতীয় সূত্র থেকে বলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আলোচনা করব।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা:
সুন্নাত তাদের পুকুর ঘাটের আম গাছের নিচে বসেছিল। এক সময় একটি পাকা আম তার গায়ের উপর পড়ল। আমটি খেতে খেতে সে ভাবতে লাগল আমের প্রতি পৃথিবীর আকর্ষণের কথা ।
স্যুটকেসকে সহজে টেনে নেওয়ার জন্য এর নিচে চাকা লাগানো থাকে। এ চাকাকে গতিশীল করার জন্য বল বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়।
জয় একটি মার্বেলকে মাটিতে গড়িয়ে দিয়ে এর দূরত্ব পরিমাপ করল। একই মার্বেলকে সে আবার তাদের পাকা মেঝেতে গড়িয়ে দিয়ে সেগল মার্বেলটি মাটি থেকে মেঝেতে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে।
কোনো কিছুকে দূরে সরাতে চাইলে আমরা সেটাকে ঠেলি বা ধাক্কা দিই। আবার কোনো কিছুকে কাছে আনতে চাইলে আমরা তাকে টানি। কোনো বস্তুর উপর অন্য বস্তুর ধাক্কা বা টানাই হচ্ছে বল প্রয়োগ। যখনই আমরা কোনো কিছুকে ঠেলি বা টানি, উঠাই বা নামাই তখন আমরা আসলে বল প্রয়োগ করি। যখন কোনো কিছুকে মোচড়াই বা ছিঁড়ি, প্রসারিত করি বা সংকুচিত করি, তখনো বল প্রয়োগ করতে হয় কিন্তু এই অধ্যায়ে আমরা শুধু বলের মাধ্যমে গতি পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনা করব। আমরা সবাই দেখেছি স্থির বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করা হলে সেটি নড়ে আবার নড়তে থাকা বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে সেটি থামানো যায়। অর্থাৎ বল প্রয়োগ করে বস্তুর গতির পারিবর্তন করা যায়। বিজ্ঞানী নিউটন বল, ভর, জড়তা ও গতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে তিনটি সূত্র প্রকাশ করেন। এই তিনটি সূত্র নিউটনের গতিবিষয়ক সূত্র নামে পরিচিত। নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে আমরা বস্তুর জড়তা ও বল সম্পর্কে ধারণা পাই।
এ প্রসঙ্গে নিউটনের প্রথম সূত্র হলো:
বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থিরই থাকবে এবং সমবেগে চলতে থাকা বস্তু সমবেগে চলতে থাকবে।
নিউটনের প্রথম সূত্রের প্রথম অংশ নিয়ে কারো সমস্যা হয় না, কারণ আমরা সব সময়েই দেখেছি স্থির বস্তুকে ধাক্কা না দেওয়া পর্যন্ত সেটা নিজে থেকে নড়ে না, স্থির থেকে যায়। দ্বিতীয় অংশটি নিয়ে সমস্যা, কারণ আমরা কখনোই কোনো চলন্ত বস্তুকে অনন্তকাল চলতে দেখি না। ধাক্কা দিয়ে কোনো বস্তুকে গতিশীল করে ছেড়ে দিলেও দেখা যায় কোনো বল প্রয়োগ না করলেও শেষ পর্যন্ত বস্তুটা থেমে যায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, যেকোনো কিছুকে সমবেগে চালিয়ে নিতে হলে ক্রমাগত বুঝি সেটাতে বল প্রয়োগ করে যেতে হয়। নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি সেটা সত্যি নয়, সমবেগে চলতে থাকা কোনো বস্তু যদি থেমে যায় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে কোনো না কোনোভাবে বল প্রয়োগ করা হয়েছে। ঘর্ষণ, বাতাসের বাধা এ রকম অনেক কিছু আসলে উল্টো দিক থেকে বল প্রয়োগ করে চলমান একটা বস্তুকে থামিয়ে দেয়। যদি সত্যি সত্যি সব বল বন্ধ করে দেওয়া যেত, তাহলে আমরা সত্যিই দেখতে পেতাম সমবেগে চলতে থাকা একটা বস্তু অনন্তকাল ধরে চলছে।
আমরা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে দেখি, প্রত্যেক বস্তু যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় থাকতে চায়। বস্তু স্থির থাকলে স্থির থাকতে চায় আর গতিশীল থাকলে গতিশীল থাকতে চায়। বল প্রয়োগ না করা পর্যন্ত বস্তু যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় থাকতে চাওয়ার যে প্রবণতা, সেটাই হচ্ছে জড়তা। স্থিতিশীল বস্তুর স্থির থাকতে চাওয়ার প্রবণতাকে বলে স্থিতি জড়তা এবং গতিশীল বস্তুর সমবেগে গতিশীল থাকার প্রবণতাকে বলে পতি জড়তা।
জড়তার ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা
থেমে থাকা বাস হঠাৎ চলতে শুরু করলে বাসযাত্রীরা পিছনের দিকে হেলে পড়েন জড়তার কারণে । বাস যখন থেমে থাকে, তখন যাত্রীর শরীরও স্থির থাকে। কিন্তু হঠাৎ বাস চলতে শুরু করলে যাত্রীদের শরীরের বাসের সিটে বসে থাকা বাসসংলগ্ন অংশ গতিশীল হয় কিন্তু শরীরের উপরের অংশ জড়তার জন্য স্থির থাকে এবং স্থির থাকতে চার বলে পিছনে হেলে পড়ে।
চলন্ত বাস থেকে নামতে পেলে ঠিক তার বিপরীত ব্যাপারটি ঘটে। পুরো শরীরটি গতিশীল অবস্থায় পা যখন মাটি স্পর্শ করে, তখন শরীরের নিচের অংশ স্থির হয়ে গেলেও উপরের অংশ গতিশীল থেকে যায় এবং যাত্রী সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়।
একক কাজ:
একটি গ্লাসের উপর একটা কার্ড, বোর্ড বা শক্ত কাগজ রেখে তার উপর করেন রাখ। (চিত্র: ১০.০১)। হঠাৎ কার্ডটিকে জোরে টোকা দাও। কী দেখলে?
কয়েনটি প্লাসের মধ্যে পড়ে গেল কেন? হঠাৎ জোরে টোকা দেওয়ার জন্য কার্ডটি সরে গেল, কিন্তু জড়তার কারণে কয়েনটি তার নিচ্ছ স্থির অবস্থান বজায় রাখতে চাওয়ার জন্য গ্লাসের মধ্যে পড়ে গেল।
পাড়ি চালনার সময় গাড়ির সব আরোহীকে পতি জড়তার বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সিটবেল্ট পরতে হয়। সিটবেল্ট ছাড়া চলমান গাড়ির চালক যদি হঠাৎ ব্রেক করেন, কিংবা দুর্ঘটনার মাঝে পড়ে তখন জড়তার কারণে তিনি সামনে ঝুঁকে পড়বেন এবং স্টিয়ারিং কিংবা উইন্ড স্ক্রিনে আঘাত পাবেন (চিত্র ১০.২)। চিত্রের দ্বিতীয় অংশে দেখা যাচ্ছে, সিট বেল্ট চালককে উইন্ড স্ক্রিনে আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা করছে। কোনো বস্তুর দিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও আমরা জড়তার প্রভাব অনুভব করি। যদি কোনো বাস বা গাড়ি হঠাৎ বাঁক নেয়, তাহলে যাত্রীরা অন্য পাশে ঝুঁকে পড়ে। এর কারণ আরোহীও বাস বা গাড়ির গতির দিকে গতিশীল ছিলেন, বাস বা গাড়ি হঠাৎ দিক পরিবর্তন করলেও জড়তার কারণে আরোহীর মূল দিক বজায় রেখে গতিশীল থাকতে চান, তাই বাসের সাপেক্ষে অন্য পাশে সরে যান।
আমরা নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে জেনেছি যে বস্তুর গতির অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে অর্থাৎ স্থির বস্তুকে গতিশীল করতে হলে বা গতিশীল বস্তুর গতির পরিবর্তন করতে হলে বল প্রয়োগ করতে হবে। বস্তুর জড়তা থাকার কারণে এ বল প্রয়োগ করতে হয়। যে বস্তুর জড়তা যত বেশি, তার অবস্থা পরিবর্তনের জন্য তত বেশি বল দিতে হবে। জড়তার পরিমাণ হচ্ছে ভর, সুতরাং যে বস্তুর ভর যত বেশি হবে, গতির পরিবর্তন করতে হলে সেই বস্তুর উপর তত বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট ভরের বস্তুর উপর কতখানি বল প্রয়োগ করা হলে বস্তুটির বেগের কতখানি পরিবর্তন হবে, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র সেটি ব্যাখ্যা করেছে। তবে নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রটি জানার আগে আমাদের দুটো রাশির কথা জানতে হবে। একটি হচ্ছে ভরবেগ অন্যটি ত্বরণ।
ভরবেগ: ভরবেগ হচ্ছে ভর এবং বেগের গুণফল। অর্থাৎ কোনো বস্তুর ভর m এবং বেগ v হলে ভরবেগ p হচ্ছে : p = mv যদি ভরের পরিবর্তন না হয়, তাহলে ভরবেগের পরিবর্তন হচ্ছে বেগের পরিবর্তনের সাথে ভরের গুণফল। অর্থাৎ m ভরের কোনো বস্তুর বেগ u থেকে বেড়ে v হলে তার ভরবেগের পরিবর্তন m(vu)।
ত্বরণ: ত্বরণ হচ্ছে বেগের পরিবর্তনের হার। অর্থাৎ কোনো বস্তুর বেগ যদি t সময়ে u থেকে পরিবর্তিত হয়ে v হয়, তাহলে তার ত্বরণ a হচ্ছে : a = (v-u)/t আমরা যদি ভরবেগ এবং ত্বরণ বুঝে থাকি তাহলে নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রটি বোঝা খুবই সহজ। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রটি হলো, বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক। তবে বলকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে আমরা সমানুপাতিক না বলে “সমান” বলতে পারি। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, কোনো বস্তুর ভরবেগ সমরে mu থেকে পরিবর্তিত হয়ে my হলে তার ভরবেগের পরিবর্তনের হার ma = m(v-u)/t প্রযুক্ত বল F-এর সমান হবে। অর্থাৎ, F=(m(v-u) t = ma বলের একক নিউটন। যে পরিমাণ বল এক কিলোগ্রাম ভরের কোনো বস্তুর ওপর প্রযুক্ত হয়ে এক মিটার/সেকেন্ড ত্বরণ সৃষ্টি করে তাকে এক নিউটন (N) বলে।
উদাহরণ
একটি বস্তুর ভর ২০ কেজি। এর ওপর একটি বল প্রযুক্ত হওয়ায় এর ত্বরণ হলো ২ মি./সে। প্রযুক্ত বলের মান কত ছিল?
সমাধান: এখানে, বস্তর ভর, m =২০ কেজি স্বরণ, a = ২ মি/সে বা, F = ?
আমরা জানি, F = ma
= ২০ কেজি : * ২ মি/সে
= ৪০ নিউটন
উত্তর: ৪০ নিউটন
তুমি যদি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেওয়ালে একটা ঘুষি দাও, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তুমি তোমার হাতে ব্যথা পাবে। ঘুষির মাধ্যমে “তুমি” দেওয়ালকে বল দিয়েছ, যদি দেওয়ালের ব্যথা অনুভব করার ক্ষমতা থাকত তাহলে সেটি ব্যথা অনুভব করত কিন্তু তুমি কেন ব্যথা পেয়েছ? কারণটি তুমি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ। তুমি যখন তোমার মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে দেওয়ালে বল প্রয়োগ করেছ, তখন দেওয়ালটিও তোমার মুষ্টিবদ্ধ হাতে পাল্টা একটা বল প্রয়োগ করেছে। এটি সব সময়েই সত্যি, কোথাও বল প্রয়োগ করলে সেটিও পাল্টা বল প্রয়োগ করে।
একক কাজ: একটি রাবার ব্যান্ড হাত দিয়ে ধরে দেখ সেটি কত লম্বা। এবারে একটা ছোট বই সূতা দিয়ে রাবার ব্যান্ডের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে দাও, দেখবে রাবার ব্যান্ডটি খানিকটা লম্বা হয়ে বইটিকে ঝুলিয়ে রেখেছে।
আমরা জানি, বইটির ওজন আছে, ওজন হচ্ছে বল, কাজেই এই বল বইটিকে নিচের দিকে টানছে। বল প্রয়োগ করলে বস্তু গতিশীল হয় কিন্তু এই বইটি গতিশীল নয় বইটি স্থির, কারণ উপর থেকে রাবার ব্যান্ডটি প্রসারিত হয়ে বইটিকে উপরের দিকে টেনে এজনের বলটুকু নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, বইটা রাবার ব্যান্ডকে নিচের দিকে টানছে (তাই রাবার ব্যান্ডটা একটু খানি লম্বা হয়ে গেছে) আবার রাবার ব্যান্ডটা বইটাকে উপরের দিকে টানছে। (ভাই বইটা নিচে পড়ে না গিয়ে স্থির হয়ে আছে)। উপরের উদাহরণগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই, আমরা যখনই কোথাও কোনো বল প্রয়োগ করি, তখনই বিপরীত দিকে একটা বল তৈরি হয়। একটি বলকে ক্রিয়া (বল) বলা হলে অন্যটিকে আমরা প্ৰতিক্ৰিয়া (বল) বলতে পারি। আইজ্যাক নিউটন তিনি তাঁর গতিবিষয়ক তৃতীয় সূত্রে বলেছেন: প্রত্যেক ক্রিয়া বলেরই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া বল আছে।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বল সবসময়ই একটি অন্যটির ওপর কাজ করে—কখনোই একই বস্তুর ওপর কাজ করে না। অর্থাৎ A বস্তু যদি B বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে তাহলে B বস্তু A বস্তুর উপর বিপরীত দিকে সমান বল প্রয়োগ করবে। প্রতিক্রিয়া বলটি ততক্ষণই থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রিয়া বলটি থাকবে। ক্রিয়া থেমে গেলে প্রতিক্রিয়াও থেমে যাবে। এ ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বলদ্বয় বস্তুগুলোর স্থিরাবস্থায় বা গতিশীল অবস্থায় বা সাম্যাবস্থায় থাকা বা একে অপরের সংস্পর্শে থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভরশীল নয়—সর্বত্রই বর্তমান থাকে।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কয়েকটি উদাহরণ
নিউটনের তৃতীয় সূত্র বোঝার সবচেয়ে সোজা উপায় হচ্ছে আমরা কীভাবে হাঁটি সেটা বোঝা। আমরা সবাই হাঁটতে পারি, এর পেছনে কি পদার্থবিজ্ঞান আছে, সেটা না জেনেই সবাই হাঁটে। কিন্তু ভোমরা যেহেতু পদার্থবিজ্ঞান শিখতে শুরু করেছ, তোমাদের খুব সহজ একটা প্রশ্ন করা যায়। তুমি যেহেতু স্থির অবস্থা থেকে হাঁটতে পার, কাজেই আসলে তোমার একটি ত্বরণ হচ্ছে, যার অর্থ তোমার উপর বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, কেউ আমাদের উপর বল প্রয়োগ করে না। আমরা নিজেরাই হাঁটি। কেমন করে সেটা সম্ভব?
নিউটনের তৃতীর সূত্র না জানা থাকলে আমরা কখনোই হাঁটার বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারতাম না। আমরা যখন হাঁটি, তখন আমরা পা দিয়ে মাটিতে ধাক্কা দিই (অর্থাৎ বল প্রয়োগ করি), তখন মাটিটা নিউটনের তৃতীর সূত্র অনুযায়ী আমাদের শরীরে সমান এবং বিপরীত বল প্রয়োগ করে (চিত্র ১০.০৩)। এই সমান এবং বিপরীত বলটা দিয়েই আমাদের ক্ষরণ হয়, আমরা হাঁটি। একইভাবে মাঝি যখন লগি দিয়ে নদীর তলার মাটিকে ধাক্কা দেয়, তখন নৌকা সামনের দিকে এগিয়ে যায় (চিত্র ১০.০৪)।
চিত্র ১০.০৩: একজন মানুষ হাঁটার সময় পা দিয়ে যখন মাটিকে ধাক্কা দেয়, তখন মাটিও মানুষটিকে পাল্টা ধাক্কা দেয়।
চিত্র ১০.০৪: মাঝি লগি দিয়ে নৌকা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টা যাদের বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছে, তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়, শক্ত মাটিতে হাঁটা সোজা কিন্তু ঝুরঝুরে বালুর উপর হাঁটা সোজা না, তার কারণ বালুর ওপর বল প্রয়োগ করা যায় না, বালু সরে যায়— তাই নিউটনের তৃতীয় সূত্রের পাল্টা বলটাও ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা আরো অনেক স্পষ্ট করে দেওয়া যায় যদি কাউকে অসম্ভৰ মসৃণ একটা মেঝেতে সাবান পানি কিংবা তেল দিয়ে পিচ্ছিল করে হাঁটতে দেওয়া হয়! সেখানে ঘর্ষণ খুব কম, তাই আমরা পিছনে বল প্রয়োগ করতেই পাৱৰ না এবং সে জন্য তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের ওপর কোনো বলও পাব না! আর তাই হাঁটতেও পারব না (বিশ্বাস না হলে চেষ্টা করে দেখতে পার)। বল প্রয়োগ করলে বিপরীত এবং সমান বল পাওয়া যায়, যদি প্রয়োগ করতেই না পারি তাহলে তার প্রতিক্রিয়া বল পাব কেমন করে? আর হাঁটব কেমন করে?
তুমি ওজন মাপার যন্ত্রের উপর দাঁড়াও। সেখানে তোমার ওজন দেখতে পাবে, এটি হচ্ছে ওজন মাপার যজ্ঞের উপর তোমার প্রযুক্ত বল। এখন তুমি যদি উপরে উঠতে চাও তাহলে নিশ্চিতভাবে নিচ থেকে তোমার উপর উপরের দিকে বল প্রয়োগ করতে হবে। সেই বলটি কোথা থেকে আসবে?
একক কাজ: তুমি একটি লাফ দিয়ে দেখ। দেখবে মুহূর্তের জন্য ওজন মাপার যন্ত্রের কাঁটাটি সরে গিয়ে অনেক বেশি ওজন দেখাচ্ছে। তুমি এই বাড়তি বলটুকু মুহূর্তের জন্য নিচের দিকে প্রয়োগ করেছে এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওজন মাপার যন্ত্রটি তোমার উপর উপরের দিকে বল প্রয়োগ করছে। সেই প্রতিক্রিয়া বলের কারণে তুমি উপরে উঠতে পেরেছ।
একক কাজ: একটি বেলুন নিয়ে একে ভালোভাবে ফোলাও। হাত দিয়ে শক্ত করে মুখ বন্ধ করে রাখ। এর পর হঠাৎ হাত ছেড়ে বেলুনটিকে মুক্ত করে দাও। (চিত্র: ১০.০৫)। কী দেখলে? তুমি দেখবে বেলুনটি উড়ে বেড়াচ্ছে! বেলুনটিকে যখন ফোলানো হয়েছে তখন বেগুনের রাবারটি প্রসারিত হয়ে ভিতরকার বাতাসের উপর একটা চাপ সৃষ্টি করেছে। যখন তুমি বেলুনের মুখটি ছেড়ে দিয়েছ, তখন বেলুনটি ভেতরকার বাতাসের উপর বল প্রয়োগ করে বেলুনের মুখ দিয়ে সঙ্গোরে বের করতে শুরু করেছে। বেলুনটি যখন বাতাসের উপর বল প্রয়োগ করতে শুরু করেছে, তখন বেলুনের বাতাসও বেলুনটির উপর বল প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। এই বলের কারণে বেলুনটি বিপরীত দিকে ছুটতে শুরু করেছে।
চিত্র ১০.০৫: বেলুন থেকে পিছন দিকে বাতাস বের হওয়ার সমর বেলুনটি সামনে এগিয়ে যায়।
১০.৪.১ চারটি মৌলিক বল
পৃথিবীতে কত ধরনের বল আছে জিজ্ঞেস করা হলে তোমরা নিশ্চয়ই বলবে অনেক ধরনের। কোনো কিছুকে যদি ধাক্কা দিই, সেটা একটা বল, ট্রাক যখন বোঝা টেনে নিয়ে যায়, সেটা একটা বল, ঝড়ে যখন গাছ উপড়ে পড়ে, সেটা একটা বল, চুম্বক যখন লোহাকে আকর্ষণ করে সেটা একটা বল, বোমা বিস্ফোরণে যখন ঘরবাড়ি উড়িয়ে দেয়, সেটা একটা বল, ক্লেন যখন কোনো কিছুকে টেনে তোলে সেটা একটা বল। একটুখানি সময় দিলেই এ রকম নানা ধরনের বলের তোমরা একটা বিশাল তালিকা তৈরি করতে পারবে।কিন্তু চমকপ্রদ ব্যাপারটি কী জান? প্রকৃতিতে মাত্র চার রকমের বল রয়েছে, ওপরে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে বিশ্লেষণ করা হলে দেখা যাবে, এগুলো ঘুরে-ফিরে এই চার রকমের বাইরে কোনোটা নয়। আসলে মৌলিক বল মাত্র চারটি। সেগুলো হচ্ছে: মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বক বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল ও সকল নিউক্লীয় বল।
মহাকর্ষ বল (Gravitation)
এই সৃষ্টিজগতের সকল বস্তু তাদের ভরের কারণে একে অপরকে যে বল দিয়ে আকর্ষণ করে, সেটাই
হচ্ছে মহাকর্ষ বল। এই মহাকর্ষ বলের কারণে গ্যালাক্সির ভেতরে নক্ষত্ররা ঘুরপাক খায় কিংবা সূর্যকে
ঘিরে পৃথিবী ঘোরে, পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদ ঘোরে। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল যখন আমাদের ওপর কাজ করে, আমরা সেটাকে বলি মাধ্যাকর্ষণ। এই মাধ্যাকর্ষণ বল আমাদেরকে নিচের দিকে (পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে) টেনে রেখেছে এবং এর কারণেই আমরা নিজেদের ওজনের অনুভূতি পাই। পদার্থবিজ্ঞানের একটি চমকপ্রদ বল হচ্ছে মহাকর্ষ বল। ভর আছে সেরকম যেকোনো বস্তু অন্য বস্তুকেমহাকর্ষ বল দিয়ে আকর্ষণ করে।
তড়িৎ চৌম্বক বল বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল (Electromagnetic Force)
চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে সেটা দিয়ে কাগজের টুকরোকে আকর্ষণ করা বা চুম্বক দিয়ে অন্য চুম্বককে আকর্ষণ-বিকর্ষণ আমাদের অনেকেই কখনো না কখনো করেছি। যদিও তড়িৎ বা বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের বলকে আলাদা ধরনের বল মনে হয়, আসলে দুটি একই বল শুধু দুইভাবে দেখা যায়। শুধু এই বলটা আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ দুটোই করতে পারে অন্যগুলো শুধু আকর্ষণ করতে পারে বিকর্ষণ করতে পারে না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তুলনায় এটা অনেক শক্তিশালী (১০৩৬ গুণ বা ট্রিলিওন ট্রিলিওন ট্রিলিওন গুণ শক্তিশালী!) কথাটা যে সত্যি সেটা নিশ্চয়ই তোমরা সহজেই অনুমান করতে পারবে। কারণ যখন তুমি একটা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে একটা কাগজকে আকর্ষণ করে তুলে নাও, তখন কিন্তু সেই কাগজটাকে পুরো পৃথিবী তার সমস্ত ভর দিয়ে তৈরি মাধ্যাকর্ষণ বল দিয়ে টেনে রাখার চেষ্টা করে, তবুও তোমার চিরুনির অল্প একটু বিদ্যুৎ সেই বিশাল পৃথিবীর পুরো মাধ্যাকর্ষণকে হারিয়ে দেয়।
দুর্বল নিউক্লীয় বল (Weak Force)
এটাকে দুর্বল বলা হয় কারণ এটা তড়িৎ চৌম্বক বল থেকে দুর্বল (প্রায় ট্রিলিওন গুণ) কিন্তু মোটেও মহাকর্ষ বলের মতো এত দুর্বল নয়। মহাকর্ষ এবং তড়িৎ চৌম্বক বল যেকোনো দূরত্ব থেকে কাজ করতে পারে কিন্তু এই বলটা খুবই অল্প দূরত্বে (১০-১৮ “m” ) কাজ করে। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে যে বেটা (B) রশ্মি বা ইলেকট্রন বের হয় সেটার কারণ এই দুর্বল নিউক্লীয় বল।
সবল নিউক্লীয় বল (Strong Nuclear Force)
এটি হচ্ছে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী বল, তড়িৎ চৌম্বক বল থেকেও একশগুণ বেশি শক্তিশালী কিন্তু এটাও খুবই অল্প দূরত্বে (১০-১৫ “m” ) কাজ করে। পরমাণুর কেন্দ্রে যে নিউক্লিয়াস রয়েছে তার ভেতরকার প্রোটন এবং নিউট্রনের নিজেদের মাঝে এই প্রচণ্ড শক্তিশালী বল কাজ করে নিজেদের আটকে রাখে। প্রচণ্ড বলে আটকে থাকার কারণে এর মাঝে অনেক শক্তি জমা থাকে তাই বড় নিউক্লিয়াসকে ভেঙে কিংবা ছোট নিউক্লিয়াসকে জোড়া দিয়ে এই বলের কারণে অনেক শক্তি তৈরি করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার বোমা সে জন্য এত শক্তিশালী। সূর্য থেকে প্রাপ্ত আলো ও তাপ এই বল দিয়ে তৈরি হয়।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই চার ধরনের বলের মূল এক জায়গায় এবং তাঁরা সবগুলোকে এক সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। তড়িৎ চৌম্বক (বিদ্যুৎ চৌম্বকীয়) এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বলকে এর মাঝে একই সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে এবং সেটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি আকাশছোঁয়া সাফল্য। (কাজেই তুমি ইচ্ছে করলে বলতে পার বল তিন ধরনের: মহাকর্ষ, ইলেকট্রো উইক (Electro- weak) এবং নিউক্লিয়ার বল। (কেউ এটাকে ভুল বলতে পারবে না) অন্যগুলোকেও একসূত্রে গাঁথার জন্য বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
তোমরা যখন তোমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা কাজে বল ব্যবহার কর তখন তোমাদের মনে হতে পারে কোনো কোনো বল প্রয়োগ করতে হলে স্পর্শ করতে হয় (ক্রেন দিয়ে ভারী জিনিস তোলা, কোনো কিছুকে ধাক্কা দেওয়া, কিংবা চলতে চলতে ঘর্ষণের জন্য চলন্ত বস্তুর থেমে যাওয়া) আবার তোমরা লক্ষ করেছ, কোনো কোনো বল প্রয়োগের জন্য স্পর্শ করতে হয় না (কোনো কিছু ছেড়ে দিলে মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য নিচে পড়া, চুম্বকের আকর্ষণ) কাজেই আমরা বলকে স্পর্শ এবং অস্পর্শ দুই ধরনের বলে ভাগ করতে পারি। স্পর্শ বলের উদাহরণ হিসেবে আমরা ঘর্ষণ বল নিয়ে আলোচনা করব।
যদিও আমরা ঘর্ষণ বলকে স্পর্শ বলের উদাহরণ হিসেবে আলোচনা করছি, কিন্তু তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমরা যেখানে স্পর্শ করছি বলে ধারণা করছি, সেখানে কিন্তু পরস্পরের অণু-পরমাণু, তাদের খিরে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন সরাসরি স্পর্শ দিয়ে নয়, তাদের তড়িৎ চৌম্বক বল দিয়ে একে অন্যের সাথে কাজ করছে। অন্য কথায় বলা যায়, আমরা যদি আণবিক পারমাণবিক পর্যায়ে চলে যাই, তাহলে সব বলই অস্পর্শক। এক পরমাণু অন্য পরমাণুকে আকর্ষণ-বিকর্ষণ করে দূর থেকে, তাদেরকে আক্ষরিক অর্থে স্পর্শ করতে হয় না ।
ধরা যাক, একটা টেবিলে কোনো একটা কাঠের টুকরো রয়েছে এবং সেই কাঠের টুকরোর ওপর বল প্রয়োগ করে সেখানে ত্বরণ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি। ধরা যাক, ১০.০৬ চিত্রে যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেভাবে ভরটির ওপর বাম থেকে ডানে F বল প্রয়োগ করছি, দেখা যাবে কাঠের টুকরোয় টেবিলের সাথে কাঠের টুকরোর ঘর্ষণের কারণে একটা ঘর্ষণ বল f তৈরি হয়েছে এবং সেটি ডান থেকে বাম দিকে কাজ করে প্রয়োগ করা বলটিকে কমিয়ে দিচ্ছে। কাঠের টুকরোর ওপরে যদি খানিকটা ওজন বসিয়ে দিই, দেখা যাবে ঘর্ষণ বল আরো বেড়ে গেছে। ঘর্ষণ বল কীভাবে তৈরি হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলেই আমরা দেখব এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে কাঠ, টেৰিলকে (কিংবা যে দুটো তলদেশের মাঝে ঘর্ষণ হচ্ছে) অনেক মসৃণ মনে হয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলে দেখা যাবে (চিত্র ১০.০৭) সব তলদেশেই এবড়োখেবড়ো এবং এই এবড়োখেবড়ো অংশগুলো যখন একে অন্যকে স্পর্শ করে বা খাঁজগুলো একে অন্যের সাথে আটকে যায়, সেটার কারণেই গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং আমরা বলি বিপরীত দিক থেকে ঘর্ষণ বলের জন্ম হয়েছে।
যদি দুটো তলদেশকে আরো চাপ দেওয়া হয় তাহলে এবড়োখেবড়ো অংশ আরো বেশি একে অন্যকে স্পর্শ করবে, একটির খাঁজ অন্যটির আরো গভীর খাঁজে ঢুকে যাবে এবং ঘর্ষণ বল আরো বেড়ে যাবে ।
ঘর্ষণ এর জন্য তাপ সৃষ্টি হয়। সেটা অনেক সময় সমস্যা। যেমন গাড়ির সিলিন্ডারে পিস্টনকে ওঠা-নামা করার সময়ে সেখানে ঘর্ষণের জন্য তাপের সৃষ্টি হয় আর সেই তাপ নিরক্ষণ করার জন্য গাড়ির ইঞ্জিনকে শীতল রাখতে হয়। তাই সেখানে ঘর্ষণ কমানোর জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আমরা সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি যে ঘর্ষণের কারণে তাপশক্তি তৈরি হয়। শীতের দিনে আমরা হাত ঘসে হাত উত্তপ্ত করি। গাড়ির ইঞ্জিন যে গরম হয়ে ওঠে, সেটিও ঘটে ঘর্ষণের কারণে। কাজেই ঘর্ষণের কারণে অপ্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে শক্তির অপচয় হয়। গাড়ি,প্লেন, জাহাজ, সাবমেরিনকে ঘর্ষণ বলকে পরাস্ত করে এগিয়ে যেতে হয়, সেখানেও অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করতে হয়। অভাবে দেখা হলে মনে হতে পারে ঘর্ষণ বুঝি আমাদের জীবনের একটি উপদ্রব ছাড়া আর কিছু নয় ।
আবার আমরা এর মাঝে দেখেছি ঘর্ষণ আছে বলেই আমরা হাঁটতে পারি, রাস্তায় গাড়ি চলতে পারে, কাগজে পেন্সিল কলম দিয়ে লিখতে পারি, দালান গড়ে তুলতে পারি, পারাস্যুট দিয়ে নিরাপদে নিচে নামতে পারি। আমরা এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি যেখানে ঘর্ষণ না থাকলে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারতাম না।
কাজেই ঘর্ষণকে উপদ্রব মনে করা হলেও আমাদের মেনে নিতে হবে এটি আমাদের জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপদ্রব।
ঘর্ষণকে চারভাগে ভাগ করা যায়। স্থিতি ঘর্ষণ, গতি ঘর্ষণ, আর্বত ঘর্ষণ এবং প্রবাহী ঘর্ষণ:
স্থিতি ঘর্ষণ (Static Friction): দুটি বস্তু একে অন্যের সাপেক্ষে স্থির থাকা অবস্থায় যে ঘর্ষণ বল থাকে, সেটা হচ্ছে স্থিতি ঘর্ষণ। স্থিতি ঘর্ষণের জন্য আমরা হাঁটতে পারি, আমাদের পা কিংবা জুতোর তলা মাটিতে স্থিতি ঘর্ষণে আটকে থাকে এবং পিছলে পড়ে যাই না।
গতি ঘর্ষণ (sliding Friction): একটি বস্তুর সাপেক্ষে অন্য বস্তু যখন চলমান হয়, তখন যে ঘর্ষণ বল তৈরি হয়, সেটি হচ্ছে গতি ঘর্ষণ। সাইকেলের ব্রেক চেপে ধরলে সেটি সাইকেলের চাকাকে চেপে ধরে এবং ঘুরন্ত চাকাকে গতি ঘর্ষণের কারণে থামিয়ে দেয়। পতি ঘর্ষণ ওজনের উপর নির্ভর করে, ওজন যত বেশি হবে, গতি ঘর্ষণ তত বেশি হবে।
আবর্ত ঘর্ষণের (Rolling Friction): একটি তলের উপর যখন অন্য একটি বস্তু পড়িয়ে বা ঘুরতে ঘুরতে চলে, তখন সেটাকে বলে আবর্ত ঘর্ষণ। সবগুলো ঘর্ষণ বলের মধ্যে এটা সবচেয়ে ছোট তাই আমরা সবসময়েই সকল রকম যানবাহনের মাঝে চাকা লাগিয়ে নেই। চাকা লাগানো স্যুটকেস খুব সহজে টেনে নেওয়া যায়- যদি এর চাকা না থাকত তাহলে মেঝের উপর টেলে নিতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হতো।
প্রবাহী ঘর্ষণ (Fluid Friction): যখন কোনো বস্তু তরল বা বায়বীয় পদার্থের (Fluid) ভেতর দিয়ে যায়, তখন সেটি যে ঘর্ষণ বল অনুভব করে, সেটি হচ্ছে প্রবাহী ঘর্ষণ। প্যারাস্যুট নিয়ে যখন কেউ প্লেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন বাতাসের প্রবাহী ঘর্ষণের কারণে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে পারে। (চিত্র ১০.০৮)
প্রবাহী ঘর্ষণ
একক কাজ: একটা কাগজ উপর থেকে ছেড়ে দাও, নিচে পড়তে কতোটুকু সময় লেগেছে অনুমান কর। এবারে কাগজটি দলামোচা করে ছোট একটা বলের মত করে ছেড়ে দাও। এবারে নিচে পড়তে কতো সময় লেগেছে? কেন? |
একক কাজ
স্থিতি ঘর্ষণ এবং গতি ঘর্ষণ
কাজ: কয়েকটা ম্যাচের খালি বাক্স নাও। সেগুলোর ভেতরে মাটি ভরে বাক্সগুলো খানিকটা ভারী করে নাও। এবারে একটা বইয়ের উপর ম্যাচ বাক্সটা রেখে বইটা ঢালু করতে থাকো। স্থিতি ঘর্ষণের কারণে ম্যাচটি পড়িয়ে যাবে না, তবে একটা নির্দিষ্ট কোলে গেলে ম্যাচ বাক্সটা পড়িয়ে পড়তে শুরু করবে। এই অবস্থায় ম্যাচ বাক্সের গতি ঘর্ষণ কার্যকর হতে শুরু করেছে। একটা ম্যাচ বাক্সের উপর আরো একটি বা কয়েকটি ম্যাচ বাক্স রেখে পরীক্ষাটি আবার করো, দেখবে প্রতিবার তুমি একই ফলাফল পাবে। একাধিক ম্যাচবাক্স রেখে তুমি ওজন বাড়িয়ে স্থিতি ঘর্ষণ বাড়িয়ে দিচ্ছ কিন্তু ঢালু করার সময় একই মাত্রায় ঢালের দিকে বলটি বেড়ে যাচ্ছে বলে ফলাফলের পরিবর্তন হচ্ছে না। |
আমরা আগেই বলেছি ঘর্ষণ বল সবসময়েই প্রয়োগ করা বলের বিপরীত দিকে কাজ করে। সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই ঘর্ষণ বল গতিকে কমিয়ে দেয় এবং আমাদের ধারণা হতে পারে আমরা সর্বক্ষেত্রে বুঝি ঘর্ষণ কমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সেটি সত্যি নয়। তোমরা নিশ্চয়ই কখনো না কখনো কাদার মাঝে কোনো গাড়ি বা ট্রাককে আটকে যেতে দেখেছ। তখন গাড়ির চাকা ঘুরলেও ঘর্ষণ কম বলে কাদা থেকে গাড়ি বা ট্রাক উঠে আসতে পারে না। ঢাকা পিছলিয়ে যায়। তখন গাড়ি বা ট্রাকটিকে তুলে আনার জন্য অন্যভাবে চাকা এবং কাদার মধ্যে ঘর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয় ।
আমরা এর মাঝে জেনে গেছি যে আমাদের প্রয়োজনে ঘর্ষণকে কখনো বাড়াতে হয় এবং কখনো কমাতে হয়।
ঘর্ষণ কমানো:
ঘর্ষণ কমানোর জন্য আমরা যেসব কাজ করি সেগুলো হচ্ছে:
১. যে পৃষ্ঠটিতে ঘর্ষণ হয়, সেই পৃষ্ঠটিকে যত সম্ভব মসৃণ করা। মসৃণ পৃষ্ঠে গতি ঘর্ষণ কম।
২. তেল মবিল বা গ্রিজ-জাতীয় পদার্থ হচ্ছে পিচ্ছিলকারী পদার্থ বা লুব্রিকেন্ট। দুটি তলের মাঝখানে এই লুব্রিকেন্ট থাকলে ঘর্ষণ অনেকখানি কমে যায়।
৩. চাকা ব্যবহার করে ঘর্ষণ কমানো যায়। চাকা ব্যবহার করা হলে বড় গতি ঘর্ষণের পরিবর্তে অনেক ছোট আবর্ত ঘর্ষণ দিয়ে কাজ করা যায়। ঘুরন্ত চাকাতে বল বিয়ারিং ব্যবহার করে সরাসরি
ঘর্ষণের বদলে ছোট স্টিলের বলগুলোর আবর্তন ঘর্ষণের সাহায্যে ঘর্ষণ অনেক কমানো সম্ভব।
৪. গাড়ি, বিমান এ ধরনের দ্রুতগামী যানবাহনের ডিজাইন এমনভাবে করা হয়, যেন বাতাস ঘর্ষণ তৈরি না করে স্ট্রিম লাইন করা পৃষ্ঠদেশের উপর দিয়ে যেতে পারে।
৫. যে দুটি পৃষ্ঠদেশে ঘর্ষণ হয়, তারা যদি খুব অল্প জায়গায় একে অন্যকে স্পর্শ করে তাহলে ঘর্ষণ কমানো যায়।
৬. আমরা দেখেছি ঘর্ষণরত দুটি পৃষ্ঠে বল প্রয়োগ করা হলে ঘর্ষণ বেড়ে যায়, কাজেই লম্বভাবে আরোপিত বল কমানো হলে ঘর্ষণ কমানো যায়।
ঘর্ষণ বাড়ানো: ঘর্ষণ কমানোর জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো করা হয়, সেগুলো করা না হলে কিংবা তার বিপরীত কাজগুলো করা হলেই ঘর্ষণ বেড়ে যায়। তাই ঘর্ষণ বাড়ানোর জন্য আমরা যে সব কাজ করি সেগুলো হচ্ছে:
১. যে দুটি তলে ঘর্ষণ হচ্ছে, সেগুলো অমসৃণ বা খসখসে করে তোলা।
২. যে দুটি তলে ঘর্ষণ হয়, সেগুলো আরো জোরে চেপে ধরার ব্যবস্থা করা।
৩. ঘর্ষণরত তল দুটির মাঝে গতিকে থামিয়ে স্থির করে ফেলা, কারণ স্থির ঘর্ষণ গতি ঘর্ষণ থেকে বেশি ।
৪. ঘর্ষণরত তলের মাঝে খাঁজ কাটা বা ঢেউ খেলানো করা। তাহলে এটি তলদেশকে জোরে আঁকড়ে ধরতে পারে। পানি বা তরল থাকলে সেটি খাঁজে ঢুকে গিয়ে পৃষ্ঠদেশের ঘর্ষণ বাড়াতে পারে।
৫. বাতাস বা তরলের ঘনত্ব বাড়ানো ।
৬. বাতাস বা তরলে ঘর্ষণরত পৃষ্ঠদেশ বাড়িয়ে দেওয়া।
৭. চাকা বা বল বিয়ারিং সরিয়ে দেওয়া।
Read more